রবিবার, মে ১৯, ২০২৪

বিদায় হজ্জের ভাষণ ও আমাদের শিক্ষা

বিশ্ব মানবতার প্রতীক হযরত মুহাম্মদ (সা.) জীবনে একবারই পবিত্র হজ্জ্ব সম্পন্ন করেছিলেন। সেই প্রথম এবং শেষ হজ্জ্বেই তিনি সমগ্র বিশ্ব জাহানের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনার নসিহত দিয়েছিলেন। সেইসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহের ভাষণকে বলা হয় বিদায় হজ্জ্বের ভাষণ।

যে ভাষণ তাঁর নবুওয়াতি জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ ও বিশেষ অধ্যায় বহন করে। এই ভাষণ ছিলো বিশ্ব মানবতার ঐতিহাসিক দলিল ও পবিত্র ইসলাম ধর্মের পরিপূর্ণতার স্বীকৃতি। একইসাথে তাতে ছিলো মুসলমানদের ব্যক্তিগত, জাতিগত ও রাষ্ট্রীয় কল্যাণের নানান নির্দেশনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ। যা আজও প্রতিটি মুমিনের তাকওয়াকে পুনরুজ্জীবিত করতে বিশেষ ভূমিকা রাখে।

রাসুলুল্লাহ (সা.) এর হজ্জ্ব পালনঃ
হজ্জ্ব ফরজ হওয়ার আগে মুশরিকদের রীতিনীতি অনুসারে যে হজ্জ্ব প্রচলিত ছিলো তা কখনোই রাসুল (সা.) পালন করেননি। তবে মক্কায় থাকা অবস্থায় দুই বার হজ্জ্ব পালনের কথা হাদিসে এসেছে। তবে বিভিন্ন সময় ওমরা পালন কথা আমরা হাদিস মারফতে জানতে পারি। বুখারি শরিফে ১৭৭৮ নাম্বার হাদিসে আনাস (রা.) থেকে কাতাদা (রহ.) একটি হাদিস বর্ণনা করেন। যেখান থেকে জানা যায়, রাসুল (সা.) জীবনে চার বার ওমরাহ পালন করেছিলেন। এবং একবারই পরিপূর্ণ হজ্জ্ব পালন করেন।

বিদায়ী হজ্জ্ব ভাষণের প্রেক্ষাপটঃ
পবিত্র হজ্জ্ব ফরজ হওয়ার পর রাসুল (সা.) ১০ম হিজরিতে পবিত্র হজ্জ্ব পালনের উদ্দেশ্যে মক্কায় যাত্রা করেন। তখন তিনি যিলহজ্জ মাসের ৯ম তারিখে আরাফার মাঠে প্রবেশ করে ‘ওয়াদিয়ে নামিরায়’ নামক স্থানে অবতরণ করেন। আর এই ‘ওয়াদিয়ে ‘নামিরায়ার’ একপাশে ছিলো আরাফা অন্যপাশে মুযদালিফা।

এই দুই জায়গাকে দুই পাশে রেখে তিনি সেখানে তাঁর উটনীর পিঠে সওয়ার অবস্থায় সমগ্র মুসলিমদের উদ্দেশ্যে এক জ্ঞানগর্ভ ভাষণ প্রদান করেন। (যাদুল মা‘আদ, ২য় খণ্ড, পৃঃ ২১৫)

এখানে তিনি লক্ষাধিক সাহাবিদের সামনে রেখে তাঁর ভাষণ দিয়েছিলেন। এরপর তিনি এরপরের দিন ১০ তারিখে কুরবানির দিন সকালেও আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ নসিহত সম্পন্ন ভাষণ দেন। এই দুই ভাষণই ছিলো মূলত বিদায়ী হজ্জ্বের ভাষণ।

এই গুরুত্বপূর্ণ ভাষণে তিনি পুরো দ্বীন ইসলামের মূল সারাংশ তুলে ধরেছিলেন। যা তাঁর নবুয়তিজীবনের উপসংহারই বটে। কেননা তিনি জানতেন এটাই তাঁর সাহাবীদের সাথে শেষ সম্মেলন।

বিদায়ী হজ্জ্ব ভাষণের মূল বক্তব্যঃ
বিদায় হজ্জের ভাষণ সম্পর্কে আমরা বিখ্যাত মুহাদ্দিসগণ থেকে মোট ৬ টি হাদীস পেয়েছি। সেইসব হাদিস গুলোর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে রাসুলুল্লাহ (সা.) এর মোট ১৬টি বিষয়ে উপর নির্দেশনা পাওয়া যায়। যা ছিলো সমগ্র মানব জাতির, ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রীয় জীবনের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এখন উল্লেখযোগ্য সংক্ষিপ্ত বিষয় গুলো নিচে দেওয়া হলো,
• বিদায়ী হজ্জ্বই ছিলো তাঁর জীবনের সবার সাথে শেষ সাক্ষাৎ। এইকারণে যে তাঁর কথা শুনবে সেই যেন অন্যকে তাঁর নির্দেশনা পৌঁছে দেয় সেই তাগিদ দেওয়া হয়।
• আল্লাহর একত্ববাদের ঘোষণা।
• মুসলিম জামাতকে আঁকড়ে ধরা। কেননা মুসলমান মুলমানের ভাই। শাসকের কল্যাণ কামনা করা এবং পরিপূর্ণ ইসলামের অনুসারী যেকোনো শাসকের আনুগত্য করা।
• একইভাবে সমগ্র মুসলিম জাতি যেন কুরআন এবং সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরে ইসলামকে বলবৎ রাখে।
• যাবতীয় সুদ এবং সুদী ব্যবস্থার মূলৎপাটন করা।
• নারীদের সামগ্রিক অধিকার রক্ষা করা এবং তাদের বিশেষ মর্যাদা প্রদান করা।
• সমস্ত মুমিন মুসলিম পরস্পর পরস্পরের ভাই। সমগ্র মুসলিম জাতি এক পরিবার। তাই একের জন্য অন্যের রক্ত হারাম।
• দ্বীনের মধ্যে নতুনত্ব না আনা।.
• তাঁর পরবর্তীতে তাঁর উম্মতের দায়িত্ব দ্বীন প্রচার করা।
• যাবতীয় কুসংস্কার থেকে বেঁচে থাকা।
• শিরক থেকে বেঁচে থাকা।
• সর্বোপরি রিসালাতের সমাপ্তি ও রাসুল (সা.) এর রিসালাতের দায়িত্ব পালনের সর্বসম্মতিক্রমে স্বীকৃতি।
• এবং পরিপূর্ণ ইসলামের স্বীকৃতি।
উপরোক্ত এইসব বিষয় গুলোই বিভিন্ন হাদিসে নানান বর্ণনায় এসেছে।

বিদায়ী হজ্জ্বের ভাষণ ও আমাদের শিক্ষাঃ
বিদায় হজ্জ্বের ভাষণে ইসলামের নানান গুরুত্বপূর্ণ দিক উল্লেখিত হয়েছে। যা ছিলো রাসুলের (সা.) পুরো নবুওয়াতি জীবনের সারাংশ। আর এই ভাষণে নির্দেশিত সকল নির্দেশনা সকল মুলমানের মেনে চলা একান্ত কর্তব্য। এবং এইসব নির্দেশনা থেকে যেদিন মুসলিম জাতি সরে আসবে সেইদিন থেকেই এই জাতির অধঃপতন শুরু হবে। যা আমরা বর্তমান বিশ্বে প্রতিটি মুসলিম দেশে দেখতে পাচ্ছি।

তাই বিদায়ী হজ্জ্বের ভাষণ থেকে আমাদের শিক্ষণীয় অনেক কিছুই আছে। যা আমাদের প্রতিটি মুসলমানের জানা এবং তা আমাদের বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করা উচিত। নিম্নে বিদায়ী হজ্জ্ব ভাষণের গুরুত্বপূর্ণ দিক গুলো আলোচনা করা হলো।

কুরআন সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরাঃ
বিদায়ী হজ্জ্বের ভাষণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিলো, কুরআন ও সুন্নাহর আনুগত্য করা। রাসুল (সা.) বলেছেন,

‘‘আমি তোমাদের মাঝে এমন একটি জিনিস রেখে যাচ্ছি যদি তোমরা তা আকড়ে ধরো, তবে তোমরা আমার মৃত্যুর পর কখনো বিপথগামী হবে না- তা হচ্ছে আল্লাহর কিতাব।’’ (মিসকাত- ২৫৫৫)

অপর একটি বর্ণনায় এসেছে আমি তোমাদের জন্য দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি।
একটি হচ্ছে আল্লাহর কিতাব, অপরটি হলো আমার সুন্নাহ।

রাসুল (সা.) এই শেষ ভাষণ থেকে আমাদের শিক্ষা হচ্ছে, আমরা যারা ইসলামকে সত্যিকারভাবে মানি তারা অবশ্যই কুরআন এবং সুন্নাহ তথা সহিহ হাদিসের আলোকেই যেন ইসলামকে মানি। কুরআন সুন্নাহর বাইরে কারো কথায় কিংবা কোনো বড় পীর বুজুর্গ অথবা বাপ দাদার অনুসরণে ইসলাম পালন করা যাবে না। যদি আমরা কুরআন সুন্নাহর বাইরে গিয়ে ইসলাম অনুসরণ করি তাহলে আমরা পথভ্রষ্ট হয়ে যাব।

শিরকমুক্ত ঈমানঃ
আল্লাহর রাসুল তৎকালীন মুশরিকদেরকে শিরকের পথ থেকে আলোর পথে তথা আল্লাহর তাওহিদের পথে এনেছিলেন। তাই তারা বুঝতে পেরেছিল শিরক কী জিনিস। কিন্তু শয়তান কখনোই বসে থাকবে না। তার কাজ সে ঠিকই করে যাবে। যার কথা রাসুল (সা.) বিদায়ী হজ্জ্বেও উল্লেখ করে গেছেন।

তিনি বলেন যে, শয়তান তোমাদের কাছ থেকে নিরাশ হয়ে গেছে যে, তোমরা তাকে আর পূজা তথা শিরক করবে না। কিন্তু সে এমন সব কাজকে ভালো করে সাজিয়ে তোমাদের সামনে তুলে ধরবে। যেন তোমরা মনে করো এইসব খুবই ভালো কাজ। আর এইসব ছোট খাটো কাজ করেই তোমরা শিরকে লিপ্ত হবে। এতেই সে সন্তুষ্ট। (মূল হাদিস, তিরমিযী ২য় খন্ড ১৬৫ পৃঃ, ইবনু মাজাহ হজ্জ পর্ব, মিশকাত ১ম খন্ড ২৩৪ পৃঃ)।

সুতরাং শিরক হচ্ছে মারাত্মক অপরাধ যা করানোর জন্য শয়তান মুখিয়ে থাকে। অথচ আজকাল আমরা অধিকাংশ মুসলমানই জানি না শিরক কী? কী করলে শিরক হয় ইত্যাদি। যেকারণে শয়তানের ধোঁকায় পড়ে অধিকাংশ মুসলমান আজ শিরকে লিপ্ত। আর তা এমন যে আমরা এইসব কাজ খুব ভালো মনে করেই করে যাচ্ছি। যার হুশিয়ারি রাসুল (সা.) আগেই দিয়ে গেছেন।

যেমন পীরকে সিজদা করা, পীরের দরবারে মানত করা, বদনজরের জন্য কালো টিপ দেওয়া, বিপদে অলি আউলিয়াদেরকে ডেকে সাহায্য চাওয়া ইত্যাদি। যা আমরা খুব ভালো করেই করে থাকি। কিন্তু আমরা কখনোই তা গভীরভা‌বে খেয়াল করি না বলে নিজেদের অজান্তেই ঈমানহারা হয়ে যাচ্ছি।

সমস্ত কুসংস্কার রহিতঃ
বিদায়ী হজ্জ্বের নির্দেশের মাধ্যমে পৃথিবীর যাবতীয় কুসংস্কার আল্লাহর রাসুল (সা.) রহিত করে দিলেন। ইবনু হিশাম ২/৬০৪ এর বর্ণনায় এসেছে, “শোন মানব সকল, জাহেলী যুগের সকল কিছু আমার পায়ের তলে পিষ্ট হল।”

উপরোক্ত হাদিসের মাধ্যমে সমস্ত কুসংস্কার এবং রক্তদাবি রহিত করা হয়েছে। আল্লাহর রাসুল (সা.) সকল প্রকার কুসংস্কার রহিত করে দিলেও, আমাদের উপমহাদেশের মুসলিম সমাজের প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে কুসংস্কারের বীজ রোপিত আছে। যেকারণে আমাদের অধিকাংশ পরিবার এখনো কুসংস্কার থেকে বের হতে পারি। এমনকি এইসব কুসংস্কার বিশ্বাসের ফলে অনেকেই নিজের অজান্তে শিরকে লিপ্ত আছে।

সালাতসহ সকল ইবাদতের নির্দেশঃ
রাসুল (সা.) সবসময়ই সালাতের প্রতি ছিলেন খুবই দায়িত্বশীল। তাই তিনি সকল সময় সালাত প্রতিষ্ঠার জন্য জোর তাগিদ দিতেন। সেকারণে বিদায় হজ্জ্বেও সালাতসহ অন্যান্য সকল ইবাদতের কথা তিনি বিশেষ ভাবে উল্লেখ করেছেন।

ইবনু মাজা, ইবনু আসাকের, রহমাতুল্লিল আলামীন কিতাবের ১ম খন্ড ২২৩ পৃষ্ঠায় এসেছে, “হে লোকজনেরা! স্মরণ রাখো আমার পরে আর কোনো নবী আসবে না। কাজেই তোমাদের পরে অন্য কোন উম্মতও থাকবে না। অতএব, আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত কর, পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করো, রমাযান সিয়াম পালন করো, সন্তুষ্ট চিত্তে নিজ সম্পদের যাকাত প্রদান করো, আল্লাহর ঘরের হজ্জ্ব পালন করো এবং সৎ নেতৃত্বের অনুসরণ করো। নিষ্ঠার সঙ্গে এ সব কাজ করলে ওয়াদা মোতাবেক জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে।”

পবিত্র কুরআনে ৮২ বার সালাতের জন্য জোর তাগিদ দিয়েছেন আল্লাহ। একইসাথে তাঁর রাসুল (সা.) সর্বাবস্থায় সালাতের প্রতি মনোযোগী হতে নির্দেশ দিয়েছেন। শুধু তাইনয় সালাতের পাশাপাশি তিনি হজ্জ্ব, যাকাত, সিয়াম, ইত্যাদির পালনেরও নির্দেশ দিয়েছেন।

অথচ হাল আমলে আমাদের মুসলমানদের মধ্যে নামাজের প্রতি কোনো দায়দায়িত্ব নেই। শতকরা ৫ জন মানুষও নিয়মিত নামাজ আদায় করে না। আর অন্যান্য ইবাদত গুলো আমাদের কাছে একটি আনুমানিক ইবাদতে রূপান্তরিত হয়েছে। যেকারণে আমাদের ঈমান আকিদা আজ ধ্বংসের পথে।

সুদ হারাম এবং হারামঃ
পবিত্র কুরআনে নির্দেশের পাশাপাশি আল্লাহর রাসুল (সা.) বিদায় হজ্জ্বে সকল প্রকার সুদ ও সুদ জাতীয় সকল কিছুকে রদ করে দিয়েছেন। কেননা সুদ এমন একটি ব্যধি যা পরিবার সমাজ সামাজিকতা সবকিছুকেই ধ্বংস করে দেয়।

মুসলিম শরিফ ১২১৮ ও ইবনু মাজাহ ৩০৭৪ এবং মিশকাত ২৫৫৫ নাম্বার হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ‘জাহেলী যুগের সুদপ্রথাকেও বাতিল করা হল। আমি প্রথম যে সুদ বাতিল করছি, তা হল আমাদের বংশের আব্বাস ইবনু আব্দুল মুত্তালিবের সুদ। তার সমস্ত সুদ বাতিল হল’।

সুতরাং পৃথিবীর যাবতীয় সুদের কার্যক্রম আজ হারাম। অথচ আমাদের অধিকাংশ মুসলমান আজ জেনে না জেনে সুদের ব্যাপক কার্যক্রমে জড়িত। যা কখনোই কোনো মুসলমানের জীবনে কল্যাণ বয়ে আনে না। যার প্রমাণ আমরা প্রতিটি গ্রাম, গঞ্জ ও শহরে আজ দেখতে পাচ্ছি।

নারী সমান অধিকার প্রদানঃ
পৃথিবীতে একমাত্র ইসলামই নারী এবং নারীর অধিকার নিয়ে চিন্তা করে। তাই পবিত্র কুরআনের পাশাপাশি আল্লাহর রাসুল (সা.) ও তাঁর শেষ নসিহতেও নারীদের কথা ভুলে যাননি। তিনি বলেন,

‘তোমরা স্ত্রীদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় কর। তোমরা তাদেরকে আল্লাহর আমানত হিসাবে গ্রহণ করেছ এবং মহান আল্লাহর-কালিমার মাধ্যমে তাহাদের লজ্জাস্থান নিজেদের জন্য হালাল করেছ। তাদের উপরে তোমাদের অধিকার এই যে, তারা যেন তোমাদের নিজ শয্যায় এমন কোন লোককে আশ্রয় না দেয়, যাকে তোমরা অপছন্দ কর।’

সুতরাং প্রতিটি নারীদের অধিকার দেওয়ার প্রতি ইসলাম খুবই সচেতন। তারপরও আমাদের অধিকাংশ মুসলিম ভাইয়েরা না জেনেবুঝে স্ত্রীদের প্রতি নানান অত্যাচার অবিচার করে থাকেন যা কখনোই কাম্য নয়।

একইভাবে এমন কিছু নারীদেরও পাওয়া যায় যারা পরকীয়ায় লিপ্ত হয়ে আল্লাহ এবং রাসুলের আদেশকে লঙ্ঘন করে। যা কখনোই উচিত নয়।

প্রতিটি মুসলিম ভাই ভাইঃ
ইসলাম এমন একটি ধর্ম যেখানে এর অনুসারীরা প্রত্যেকে পরস্পর ভাই ভাই। যা পবিত্র কুরআনে আল্লাহ সুরা হুজুরাতে উল্লেখ করেছেন। আর তাই সমগ্র দুনিয়ার মুসলিম এক অবিচ্ছেদ্য ভ্রাতৃসমাজ। ঠিক এই কথাটাই রাসুল (সা.) তাঁর শেষ ভাষণে আবারও উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন,

‘হে লোক সকল! তোমরা আমার কথা শোন ও বুঝার চেষ্টা কর। জেনে রেখো, প্রত্যেক মুসলিম একে অপরের ভাই ভাই। কাজেই নিজের ভাইয়ের কোন জিনিস তার খুশি মনে দান করা ছাড়া নেয়া অবৈধ। তোমরা নিজেদের উপর কখনোও অত্যাচার করবে না’। (ফিক্বহুস সীরাহ, পৃ. ৪৫৬)

সুতরাং একজন মুসলমান কখনোই জেনেবুঝে তার ভাইয়ের ক্ষতি করতে পারে না। অথচ আজ আমাদের মুসলমানরা পরস্পর ভাই তো দূরের কথা, নিজের আপন ভাইয়ের সাথেই ভালো সম্পর্ক নেই। যে যেভাবে পারছে সে সেভাবে তার ভাইয়ের বিরুদ্ধে গিয়ে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। রাসুল তাঁর শেষ বিদায়ী ভাষণে যা বলে গেছেন। তার থেকে আমরা আজ যোজন যোজন দূরে অবস্থান করছি।

বিশ্ব সম্প্রতি ও বর্ণপ্রথা বিলুপ্তঃ
তৎকালীন আরব সমাজসহ বিশ্বে দাসপ্রথা খুবই প্রচলিত ছিলো। যা ইসলাম আসার পরই ধীরে ধীরে বিলুপ্তি ঘটে। একইসাথে একমাত্র ইসলামেই অন্যান্য জাতি গোষ্ঠীকে নিজেদের ভাই বলে পরিচয় দেয়। যে পরিচয় রাসুল (সা.) তাঁর ভাষণে বলে গেছেন।

তিনি বলেছেন যে, সকলেরই সৃষ্টিকর্তা একজন। আর তিনি হচ্ছেন আল্লাহ। আর তাই তোমাদের পিতাও একজন। যেকারণে আরব অনারব বলে কোনো ভেদাভেদ নেই। লাল সাদার উপর মর্যাদা নেই। একইভাবে সাদা কালোর উপর মর্যাদা নেই। বরং সকলেরই সমান। (মূল হাদিস মুসনাদে আহমাদ ২৩৫৩৬; সিলসিলা সহীহাহ ২৭০০; সহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব ২৯৬৩, সনদ হাসান।)

সুতরাং ইসলামে কখনোই বর্ণবৈষম্য নেই। কেউ কারো উপরে নয় শুধুমাত্র তাকওয়া ছাড়া। অথচ আমাদের সমাজে প্রতিটি কোণায় আজও ছোট বড় উচুঁ নিচু জাতপাতের নানান দৃশ্য এখনও দেখা যায়। যা কখনোই ইসলামে কাম্য নয়। বিশেষ করে ধনী গরিবের নানান বৈষম্য আজ সমাজ কলুষিত করছে প্রতিনিয়ত।

ইসলাম প্রচারের নির্দেশঃ
আল্লাহ প্রতিটি নবী-রাসুল (আ.) কে পৃথিবীতে প্রেরণ করেছিলেন তাওহীদের প্রচার এবং প্রসারের জন্য। আর সেই প্রচার প্রচারণা শেষ দায়িত্ব ছিলো মুহাম্মদ (সা.) উপর। তিনি তাঁর রিসালাতের দায়িত্ব সম্পূর্ণ করে তাঁর এই প্রচার প্রচারণার দায়িত্ব প্রতিটি মুসলমানের উপর অর্পিত করে গেছেন।

মুসলিম ১৬৭৯, ১২১৮, ইবনু মাজাহ ৩০৭৪, মিশকাত ২৫৫৫, বুখারী ১৭৩৯ নং হাদিসে এসেছে, “আমার সম্পর্কে তোমাদের জিজ্ঞাসা করা হলে কী বলবে? তখন সাহাবীরা বলল, আমরা সাক্ষ্য দিব যে, আপনি (আল্লাহর বাণী) পৌঁছিয়েছেন, আপনার হক্ব আদায় করেছেন এবং সদুপদেশ দিয়েছেন। এই কথা শোনার পর রাসুল (সা.) তাঁর আঙ্গুল আকাশের দিকে তুলে লোকদের ইশারা করে বললেন, হে আল্লাহ! আপনি সাক্ষী থাকুন, হে আল্লাহ! আপনি সাক্ষী থাকুন। তিনি এটা তিনি বার বললেন।

একইসাথে তিনি এও বললেন, আমি কি আমার (রিসালাত) তোমাদের কাছে পৌঁছাতে পেরেছি? সাহাবীগণ বললেন, হ্যাঁ। তিনি বললেন, হে আল্লাহ! আপনি সাক্ষী থাকুন। অতএব হে উপস্থিত ব্যক্তিগণ! তোমরা অনুপস্থিত ব্যক্তিদের নিকট (আমার এই নসিহত) পৌঁছে দিবে। কেননা উপস্থিত থাকা ব্যক্তির চেয়ে অনুপস্থিত থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে এমন অনেকে রয়েছে, যারা তমাদের চেয়ে অনেক বেশি সংরক্ষণকারী হবে’।

অতএব পৃথিবীতে আর নবি রাসুল আসবে না। তাই প্রতিটি মুসলমানের দায়িত্ব হলো নিজ নিজ অবস্থান থেকে ইসলামের বাণী ও সৌন্দর্য্য মানুষের কাছে তুলে ধরা। একইসাথে নিজে পরিপূর্ণ ইসলাম মেনে চলার পাশাপাশি অন্যকেও ইসলামের নানান বিষয়ে দাওআত দেওয়া। যা অনেক মুসলমানই জানে না।

অথচ এই কাজটি দিনদিন খুবই কঠিন হয়ে যাচ্ছে। যদিও আমাদের অধিকাংশ মুসলমানই ইসলাম বিমুখ। তার উপর সমাজ ও রাষ্ট্রীয় নানান অপপ্রচার ও হয়রানির কারণে দিনদিন ইসলাম প্রচার কঠিন হয়ে যাচ্ছে। যা একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশ ও একজন মুসলমান থেকে কাম্য নয়।

পরিপূর্ণ ইসলামের ঘোষণাঃ
বিদায় হজ্জ্বের দিন ইসলামের জন্য খুবই আনন্দপূর্ণ একটি দিন ছিলো। হযরত আদম (আ.) এর হাত ধরে যে দ্বীন পৃথিবীতে রচিত হয়েছিল। সেই দ্বীন ইসলাম হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর হাত দিয়ে সমাপ্তি লাভ করেছে। এইদিন যখনই রাসুল তাঁর সমস্ত নসিহত ঘোষণা শেষ করলেন। তখন সন্ধ্যায় আল্লাহর পক্ষ হতে ঘোষিত এক অনন্য দলীল ও ঘোষণা। যা ছিলো ইসলামের পরিপূর্ণতার সনদ। যে সনদ ইতিপূর্বে কোন এলাহী (ইহুদী, খ্রিস্টান) ধর্মের জন্য নাযিল হয়নি।

যখন এই অহী নাযিল হচ্ছিল তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) এর বাহনকৃত উট আস্তে করে বসে পড়ে। অতঃপর নাযিল হতে থাকে,
“আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীনকে পূর্নাঙ্গ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার অবদান সম্পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্যে দ্বীন হিসেবে পছন্দ করলাম। (সূরা: আল মায়িদাহ, আয়াতঃ ৩)

এই আয়াত শোনার সাথে সাথে হযরত উমর (রা:) কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। তাঁর কান্নার কথা জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি জানান, এতদিন ইসলামের দিন দিন উন্নতি হচ্ছিল। কিন্তু আল্লাহ ইসলামকে যখন পরিপূর্ণ করে দিলেন, তখন ইসলামে আর নতুন করে কোনো কিছু যোগ করার নেই। সুতরাং রাসুলের দায়িত্বও শেষ। তাই তিনি রাসুলের বিয়োগের অগ্রিম কান্নায় লুটিয়ে পড়েন।

পবিত্র কুরআনের এই আয়াত দ্বারা আল্লাহ এটা নিশ্চিত করে দিলেন যে, রাসুল (সা.) পরবর্তী ইসলামে আর নতুন করে কোনো কিছু যোগ কিংবা বিয়োগের সুযোগ নেই। অথচ আমাদের উপমহাদেশে ইসলামের আজও নতুন নতুন ইবাদত আমল প্রচলিত। যা রাসুল (সা.) শিক্ষা দেননি কিংবা তাঁর সাহাবীগণও (রা:) পালন করেননি।

যেখানে বিদায় হজ্জ্বের ভাষণ দ্বারা রাসুল যে ইসলামকে পরিপূর্ণ করে গেছেন, সেখানে আমরা পূর্বপুরুষদের অনুসরণে, পীর অলি আউলিয়াদের অনুসরণে নানান জিকির আজকারসহ বিভিন্ন ধরনের আমল করেই যাচ্ছি। যার কোনো দলিল কুরআন হাদিস সুন্নাহসহ কোথাও পাওয়া যায় না।

উপরোল্লিখিত বিষয় গুলো ছাড়াও আরো অন্যান্য নানান খুটিনাটি বিষয়ও বিদায়ী হজ্জ্বের ভাষণে উঠে এসেছিল। তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, বিদআতী আমল করা যাবে না যারা বিদআতী আমল করবে, তারা হাউয কাওছারের পানি পান হতে বঞ্চিত হবে। প্রত্যেক পরিবারের উপর প্রতি বছর একটি করে কুরবানী করা সুন্নত। কেউ কারো পাপের ভার বহন করবে না। একের পাপে অন্যে দোষী হবে না। নারীদের যথাযথ সম্মান ও অধিকার দেওয়ার পাশাপাশি তাদের সমস্ত ধরনের ভরণপোষণের দায়িত্বও পুরুষদের নিতে হবে ইত্যাদি।

শেষকথাঃ
বিদায়ী হজ্জ্বে বর্ণিত প্রতিটি বিষয়ই ব্যক্তি, জাতি ধর্ম, বর্ণ, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের চিরন্তন কল্যাণের দিশারী। তাই আমাদের প্রতিটি মুসলমানের ঈমানী দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো, রাসুল (সা.) এর নির্দেশিত সকল নসিহত মেনে চলে দ্বীন ইসলাম পালন করা। আল্লাহ আমাদের সকলকে এগুলো মেনে চলার তাওফীক দান করুন- আমীন।

লেখক পরিচিতিঃ

Faruk Hossain Mithu
Faruk Hossain Mithuhttps://mithu.kholifa.com
I'm Linux Admin, traveler with a passion for movies, tech and programming. Navigating the digital realm with expertise, I enjoy exploring diverse landscapes and staying at the forefront of technology trends. Code enthusiast and cinephile, blending a love for innovation with a sense of adventure.
- বিজ্ঞাপন -
সম্পর্কিত পোস্টগুলো
- বিজ্ঞাপন -

জনপ্রিয় পোস্টগুলো

- বিজ্ঞাপন -
error: Content is protected !!