আসসালামু আলাইকুম, উড্ডয়নে আপনাকে স্বাগতম!
কেমন আছেন? আশা করি আল্লাহর রহমতে ভালোই আছেন।
ঘুরতে যেতে কার না ভাল লাগে, কিন্তু আমরা অনেকেই ভাবি ঢাকার এই কোলাহলপূর্ণ পরিবেশে কোথায় ঘুরতে যাওয়া যায়, তাহলে চলুন আজ ঘুরে আসি ঢাকার লালবাগে অবস্থিত লালবাগ কেল্লা থেকে।
আজ আমরা কথা বলবো লালবাগ কেল্লা সম্পর্কে।
আমরা আজকে জানতে পারবো; লালবাগ কেল্লার ইতিহাস, লালবাগ কেল্লা কোথায় অবস্থিত, কিভাবে লালবাগ কেল্লায় যাওয়া যায়, লালবাগ কেল্লা যাওয়ার যাতায়াত খরচ, এন্ট্রি ফি, এবং লালবাগ কেল্লা সম্পর্কে আরো কিছু তথ্য জানানোর চেষ্টা করব।
লালবাগ কেল্লাঃ
মোঘল আমলের বাংলাদেশের একমাত্র ঐতিহাসিক নিদর্শন হচ্ছে লালবাগ কেল্লা। একমাত্র এই কেল্লাতেই একই সাথে ব্যবহার করা হয়েছে কষ্টি পাথর, মার্বেল পাথর আর রঙ-বেরঙের টালি। বাংলাদেশের আর কোনো ঐতিহাসিক নিদর্শনে এমন কিছুর সংমিশ্রণ পাওয়া যায়নি। প্রায় প্রতিদিন হাজারো দেশি-বিদেশি দর্শনার্থীর পদচারণায় মুখরিত হয় এই অসমাপ্ত এই কেল্লা।
লালবাগ কেল্লা কোথায় অবস্থিত?
লালবাগ কেল্লা ঢাকায় অবস্থিত। লালবাগের কেল্লা বা কেল্লা আওরঙ্গবাদ কেল্লা ঢাকার দক্ষিণ – পশ্চিমাঞ্চলে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত একটি অসমাপ্ত মুঘল দুর্গ।
লালবাগ কেল্লার ইতিহাসঃ
লালবাগের কেল্লা, যার আর এক নাম অথবা পূর্বের নাম আওরঙ্গবাদ কেল্লা। এটি একটি অসমাপ্ত মুঘল দুর্গ। ১৬৭৮ সালে সম্রাট আওরঙ্গজেবের ৩য় পুত্র মুঘল সুবেদার মুহাম্মদ আজম শাহ্ কর্তৃক এটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল। যদিও পরবর্তীতে সম্রাট পদপ্রাপ্ত হয়েছিলেন মুহাম্মদ আজম শাহ্। কিন্তু পরবর্তীতে দুর্গের নির্মাণ কাজ শুরু হবার কিছুদিনের মধ্যেই মারাঠা বিদ্রোহ শুরু হয় যার জন্য তার পিতা সম্রাট আওরঙ্গজেব তাকে দিল্লি ডেকে পাঠান। এসময় একটি মসজিদ ও দরবার হল নির্মাণের পর দুর্গ নির্মাণের কাজ থেমে যায়। উনার দিল্লিতে চলে যাওয়া এই কেল্লার বাকি কাজ থামিয়ে দেয়। ১৬৮০ সালে নির্মাণকাজ পুনরায় শুরু হয় তার উত্তরসূরী মুঘল সুবাদার শায়েস্তা খাঁ কর্তৃক কিন্তু তিনিও তা শেষ করতে পারেননি। কারণ ১৬৮৪ সালে মুঘল সুবাদার শায়েস্তা খাঁ এর কন্যা ইরান দুখত রাহমাত বানুর (পরী বিবি) মৃত্যু ঘটে। কন্যার মৃত্যুর পর শায়েস্তা খাঁ এ দুর্গটিকে অপয়া মনে করেন। তাতে তিনি নির্মাণ কাজ থামিয়ে দেন। ঢাকা থেকে ভারতের মুর্শিদাবাদে রাজধানী স্থানান্তর করার পর শায়েস্তা খাঁ ঢাকা ত্যাগ করেন। এবং যার কারণে পরবর্তীতে এটি এর জনপ্রিয়তা হারায় এবং দুর্গটি পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়ে যায়। ১৮৪৪ সালে এলাকাটি “আওরঙ্গবাদ” নাম বদলে “লালবাগ” নাম পায় এবং দুর্গটি পরিণত হয় লালবাগ দুর্গে।
কিভাবে যাওয়া যাবে?
লালবাগ কেল্লায় যেতে হলে অনেক ভাবেই যাওয়া যায়। ঢাকা অথবা বাংলাদেশের যেকোনো স্থান থেকে আপনাকে আগে গুলিস্তান গোলাপ শাহ্ এর মাজার এর সামনে এসে নামতে হবে। তারপর সেখান থেকে লেগুনার মাধ্যমে যাওয়া যাবে লালবাগ কেল্লায়। ইসলামবাগ ও কিল্লার মোড়গামী দু’ধরনের লেগুনা দিয়ে দিন রাত সব সময় যাওয়া যায় লালবাগ কেল্লায়। এছাড়াও নিউমার্কেট, আজিমপুর কিংবা গুলিস্তান এলাকা থেকে সরাসরি রিক্সায় যাওয়া যায় অথবা বাইকে অথবা ক্যাব অথবা সিএনজি করেও যাওয়া যাবে।
টিকেট প্রাপ্তিস্থান এবং টিকিট মূল্যঃ
লালবাগ কেল্লার দরজার ঠিক ডান পাশেই রয়েছে টিকেট কাউন্টার, জনপ্রতি টিকেট এর দাম বিশ টাকা করে, তবে পাঁচ বছরের কম কোন বাচ্চার জন্যে টিকেট এর দরকার পড়েনা। যেকোনো বিদেশি দর্শনার্থীর জন্যে টিকেট মূল্য দুইশত টাকা করে।
লালবাগ কেল্লাতে যা যা আছেঃ
লালবাগ কেল্লাতে তিনটি বিশাল দরজা রয়েছে সেখান থেকে যে দরজাটি বর্তমানে জনসাধারণের জন্যে উন্মুক্ত করে দেয়া সেই দরজা দিয়ে ঢুকলে বরাবর সোজা চোখে পড়ে পরী বিবির সমাধি। কেল্লার চত্বরে তিনটি স্থাপনা রয়েছে-
১। দরবার হল ও হাম্মাম খানা।
২। পরীবিবির সমাধি।
৩। উত্তর পশ্চিমাংশের শাহী মসজিদ।
দরবার হল ও হাম্মাম খানাঃ
লালবাগ কেল্লার যেই ভবনটি শায়েস্তা খাঁ এর বাস ভবন ছিল, এই দালান কে দুটি কাজে ব্যবহার করা হত এক. হাম্মাম খানা (বাস ভবন হিসেবে) ২. দরবার (বিচারালয় হিসেবে)। এই দালানের নিচ তালা ছিল বাস ভবন তথা হাম্মাম খানা আর উপরের তলা ছিল কোর্ট তথা দরবার। হাম্মাম খানা মূলত সুবেদারদের বাস ভবন হিসেবে ব্যবহার হত। শায়েস্তা খাঁ এই ভবনে বাস করতেন এবং এটাই ছিল তার কোর্ট। এখান থেকে তিনি সমস্ত বিচার কার্য পরিচালনা করতেন ।
পরীবিবির সমাধিঃ
লালবাগ কেল্লার তিনটি স্থাপনার মধ্যে গেইট দিয়ে ঢুকতেই যেই ভবন চোখে পরে সেইটাই পরীবিবির সমাধি। যিনি ছিলেন মুঘল সুবেদার শায়েস্তা খানের প্রিয় কন্যা। পরী বিবির সমাধিস্থল স্থাপনাটি চতুষ্কোণ। বাংলাদেশে এই একটি মাত্র ইমারতে মার্বেল পাথর, কষ্টি পাথর ও বিভিন্ন রং এর ফুল-পাতা সুশোভিত চাকচিক্যময় টালির সাহায্যে অভ্যন্তরীণ নয়টি কক্ষ অলংকৃত করা হয়েছে। কক্ষগুলির ছাদ কষ্টি পাথরে তৈরি। মূল সমাধি-সৌধের (কেন্দ্রীয় কক্ষের) উপরের এই গম্বুজটিতে একসময়ে স্বর্ণখচিত ছিল, পরবর্তীতে পিতলের ও তামার পাত দিয়ে পুরো গম্বুজটিকে মুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ২০.২ মিটার বর্গাকৃতির এই সমাধিটি ১৬৮৮ খ্রিস্টাব্দের পুর্বে নির্মিত। তবে এখানে পরীবিবির মরদেহ বর্তমানে নেই বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত।
উত্তর পশ্চিমাংশের তিন গম্বুজওয়ালা (শাহী মসজিদ) দুর্গ মসজিদঃ
কেল্লাতে একটি মসজিদ আছে, যা কিনা ১৬৭৮-৭৯ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট আওরঙ্গজেবের তৃতীয় পুত্র শাহজাদা আজম বাংলার সুবাদার থাকাকালীন নির্মাণ করেছিলেন। আজম শাহ দিল্লি চলে যাওয়ার আগেই তিনি এই মসজিদটি তৈরি করে গিয়েছিলেন। তিন গম্বুজ বিশিষ্ট এই মসজিদটি এদেশের প্রচলিত মুঘল মসজিদের একটি আদর্শ উদাহরণ যেটা কিনা যে কারো দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম। মসজিদটিতে জামায়াতে নামায আদায় করা হয়। ঢাকায় এতো পুরনো মসজিদ খুব কমই আছে।
এছাড়াও রয়েছে দুটি বিশাল তোরণ ও আংশিক ধ্বংসপ্রাপ্ত মজবুত দুর্গ প্রাচীর, পানির ট্যাংক ইত্যাদি। কেল্লাতে সুরঙ্গ পথ ও আছে, লোক মুখে শোনা যায় যে আগে নাকি সুরঙ্গ পথগুলোতে যাওয়া যেতো, তবে এখন আর যাওয়া যায়না। উল্লেখ্য সুরঙ্গ পথ এ যাওয়ার কথাটি নিতান্তই শোনা কথা, এর কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সাম্প্রতিক উৎখননে আরো অন্যান্য অনেক অবকাঠামোর অস্তিত্ব প্রকাশ পেয়েছে।
জাদুঘরঃ
বর্তমানে শায়েস্তা খাঁর বাসভবন ও দরবার হল লালবাগ কেল্লা জাদুঘর হিসেবে দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত। জাদুঘরটিতে দেখার মতো অনেক কিছুই রয়েছে। মুঘল আমলের বিভিন্ন হাতে আঁকা ছবির দেখা মিলবে সেখানে, শায়েস্তা খাঁ এর ব্যবহার্য নানান জিনিসপত্র সেখানে সযত্নে রয়েছে। তাছাড়া তৎকালীন সময়ের বিভিন্ন যুদ্ধাস্ত্র, পোশাক, সেসময়কার প্রচলিত মুদ্রা ইত্যাদিও রয়েছে।
লালবাগ কেল্লাতে এখানে ওখানে বেশ কয়েকটি ফোয়ারার দেখা মিলবে, যা শুধুমাত্র কোনো বিশেষ দিনে চালু থাকে (যেমনঃ ঈদ)।
কেল্লা বন্ধ-খোলার সময়সূচীঃ
গ্রীষ্মকালে সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত কেল্লা খোলা থাকে। মাঝখানে দুপুর ১টা থেকে ১.৩০ পর্যন্ত আধ ঘণ্টার জন্যে বন্ধ থাকে।
আর শীতকালে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে। শীতকালেও দুপুর ১টা থেকে ১.৩০ পর্যন্ত বন্ধ থাকে।
আর সবসময়ের জন্যেই শুক্রবারে জুম্মার নামাযের জন্যে সাড়ে বারোটা থেকে তিনটা পর্যন্ত বন্ধ থাকে।
রবিবার সহ সকল সরকারি ছুটির দিন লালবাগ কেল্লা বন্ধ থাকে।
আজকের মত এই পর্যন্তই, লেখায় কোন ভুল থাকলে নিজ গুনে ক্ষমা করে দিবেন, পরবর্তীতে অন্য কোন স্থান এর তথ্য নিয়ে আলোচনা করবো, আমাদের লিখাতে যদি আপনাদের সামান্য উপকার হয় তাতেই আমাদের লিখা সার্থক।
আল্লাহ্ হাফেজ।